বিছানায় ছারপোকা বা বেড বাগ (Bed Bug) একটি অতি ক্ষুদ্র পরজীবী পোকা, যা মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। এই পোকাগুলো সাধারণত বিছানা, সোফা, কার্পেট এবং অন্যান্য ফার্নিচারের ফাঁকে লুকিয়ে থাকে। ছারপোকার উপদ্রব শুধুমাত্র অপরিচ্ছন্ন পরিবেশেই হয় না, বরং যেকোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাতেও এদের বিস্তার ঘটতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিছানায় ছারপোকা কেন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ছারপোকার জীবনচক্র, তাদের বিস্তারের পদ্ধতি এবং পরিবেশগত কারণগুলো বুঝতে হবে।
ছারপোকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
ছারপোকা (Cimex lectularius) হল এক ধরনের রক্তচোষা পোকা, যা প্রায় ৫-৭ মিলিমিটার লম্বা হয়। এরা সাধারণত রাতে সক্রিয় হয় এবং মানুষের ত্বকের মাধ্যমে রক্ত চুষে খায়। ছারপোকার কামড়ে চুলকানি, লাল দাগ এবং অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এরা অত্যন্ত সহনশীল এবং দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন করে তোলে।
বিছানায় ছারপোকা হওয়ার কারণ
বিছানায় ছারপোকা হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ দায়ী। নিচে সেগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. ভ্রমণ বা ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে ছড়ানো
ছারপোকা সাধারণত ভ্রমণের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়ায়। হোটেল, মোটেল, হোস্টেল বা যেকোনো অস্থায়ী আবাসস্থলে ছারপোকা থাকলে সেখান থেকে আপনার ব্যাগ, কাপড় বা জুতার মাধ্যমে আপনার বাড়িতে চলে আসতে পারে। ভ্রমণকারীরা অজান্তেই তাদের সাথে ছারপোকা নিয়ে আসেন, যা পরে বিছানায় বা ফার্নিচারে বিস্তার লাভ করে।
২. ব্যবহৃত ফার্নিচার বা জিনিসপত্র কেনা
ব্যবহৃত ফার্নিচার, ম্যাট্রেস, কার্পেট বা অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করলে সেগুলোর মাধ্যমে ছারপোকা আপনার বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে। ছারপোকা ফার্নিচারের ফাঁকে লুকিয়ে থাকতে পারে এবং সেগুলো পরিষ্কার করার সময় দেখা নাও যেতে পারে।
৩. প্রতিবেশী বা আশেপাশের পরিবেশ
যদি আপনার প্রতিবেশীর বাড়িতে ছারপোকার উপদ্রব থাকে, তবে সেখান থেকে আপনার বাড়িতেও ছারপোকা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ছারপোকা দেয়ালের ফাঁক, বৈদ্যুতিক তার বা পাইপের মাধ্যমে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে চলে যেতে পারে।
৪. অপরিচ্ছন্নতা নয়, কিন্তু অযত্ন
অনেকের ধারণা যে শুধুমাত্র অপরিচ্ছন্ন পরিবেশেই ছারপোকা হয়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। ছারপোকা যেকোনো পরিবেশেই বাস করতে পারে, তবে অযত্ন ও অবহেলার কারণে তাদের বিস্তার দ্রুত ঘটে। নিয়মিত বিছানা, কার্পেট এবং ফার্নিচার পরিষ্কার না করলে ছারপোকার উপদ্রব বাড়তে পারে।
৫. পোষা প্রাণীর মাধ্যমে
পোষা প্রাণী যেমন কুকুর বা বিড়ালের মাধ্যমেও ছারপোকা বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে যদি পোষা প্রাণীটি বাইরে ঘুরে আসে বা অন্য কোনো পশুর সংস্পর্শে আসে।
৬. দুর্বল পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবস্থা
যদি বাড়িতে পেস্ট কন্ট্রোল বা কীটনাশক ব্যবহারের ব্যবস্থা দুর্বল হয়, তবে ছারপোকা দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। নিয়মিত কীটনাশক ব্যবহার না করলে ছারপোকার সংখ্যা বেড়ে যায়।
ছারপোকা প্রতিরোধের উপায়
বিছানায় ছারপোকা প্রতিরোধ করতে নিচের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
১. নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: বিছানা, কার্পেট এবং ফার্নিচার নিয়মিত পরিষ্কার করুন। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করে ফার্নিচারের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ছারপোকা দূর করুন।
২. ভ্রমণের সময় সতর্কতা: হোটেল বা অন্য কোনো স্থানে থাকার সময় আপনার ব্যাগ এবং কাপড় সতর্কতার সাথে রাখুন। বাড়ি ফিরে কাপড় গরম পানিতে ধুয়ে ফেলুন।
৩. ব্যবহৃত জিনিসপত্র পরীক্ষা করা: ব্যবহৃত ফার্নিচার বা জিনিসপত্র কেনার আগে সেগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।
৪. পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস: নিয়মিত পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস নিন এবং বাড়িতে কীটনাশক ব্যবহার করুন।
৫. পোষা প্রাণীর যত্ন: পোষা প্রাণীকে নিয়মিত পরিষ্কার করুন এবং তাদের বিছানা বা জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখুন।
বিছানায় ছারপোকা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন ভ্রমণ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র কেনা, প্রতিবেশীর বাড়িতে উপদ্রব বা অযত্ন। তবে সতর্কতা এবং নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে ছারপোকার উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ছারপোকা শুধুমাত্র শারীরিক অস্বস্তিই নয়, মানসিক চাপও সৃষ্টি করে। তাই সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ছারপোকা মারার ওষুধ কি?
ছারপোকা মারার জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বা কীটনাশক পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কিছু সাধারণ ওষুধ এবং তাদের ব্যবহার পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. পাইরেথ্রিন-ভিত্তিক কীটনাশক
পাইরেথ্রিন একটি প্রাকৃতিক কীটনাশক, যা গাঁদা ফুল থেকে তৈরি হয়। এটি ছারপোকা মারার জন্য খুবই কার্যকর। পাইরেথ্রিন-ভিত্তিক স্প্রে বা পাউডার বাজারে সহজলভ্য। এটি সরাসরি ছারপোকার ওপর স্প্রে করলে বা তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গায় প্রয়োগ করলে এরা মারা যায়।
২. নিওনিকোটিনয়েডস
নিওনিকোটিনয়েডস হল এক ধরনের সিনথেটিক কীটনাশক, যা ছারপোকা সহ অন্যান্য পোকামাকড়ের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এটি ছারপোকা মারার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
৩. ডায়াটমেসিয়াস আর্থ (Diatomaceous Earth)
এটি একটি প্রাকৃতিক পাউডার, যা ফসিল থেকে তৈরি হয়। এটি ছারপোকার শরীরের আর্দ্রতা শুষে নিয়ে তাদের মেরে ফেলে। এটি ব্যবহারের জন্য ছারপোকার লুকিয়ে থাকার জায়গায় (যেমন বিছানার ফাঁক, কার্পেটের নিচে) পাউডার ছিটিয়ে দিতে হয়।
৪. বিফেনথ্রিন (Bifenthrin)
বিফেনথ্রিন একটি শক্তিশালী কীটনাশক, যা ছারপোকা মারার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত স্প্রে আকারে পাওয়া যায় এবং ছারপোকার লুকিয়ে থাকার জায়গায় প্রয়োগ করতে হয়।
৫. হিট ট্রিটমেন্ট (Heat Treatment)
ছারপোকা মারার জন্য হিট ট্রিটমেন্ট একটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। ছারপোকা ৪৫°C (১১৩°F) তাপমাত্রায় মারা যায়। হিট ট্রিটমেন্টের জন্য বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে ঘর বা ফার্নিচার গরম করা হয়। এটি একটি রাসায়নিক-মুক্ত পদ্ধতি এবং খুবই কার্যকর।
৬. স্টিম ক্লিনিং
স্টিম ক্লিনার ব্যবহার করে ছারপোকা মারা যায়। গরম বাষ্প সরাসরি ছারপোকার ওপর প্রয়োগ করলে এরা মারা যায়। এটি বিছানা, কার্পেট এবং ফার্নিচারের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ছারপোকা মারার জন্য খুবই উপযোগী।